সজনে পাতার গুনাগুন | সজনে পাতার উপকারিতা

সজনে পাতার গুনাগুন | সজনে পাতার উপকারিতা - পৃথিবীতে মানব সমাজের সুস্বাস্থ্যের জন্য আল্লাহপাকের অফুরন্ত নিয়ামত রয়েছে । যার বেশির ভাগ আমাদের কাছে অজানা, যার কিছুটা বিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা জানতে পেরেছি । যেমন - সজনে পাতার উপকারিতা ।

সজনে পাতার গুনাগুন | সজনে পাতার উপকারিতা
সজনে পাতার গুনাগুন | সজনে পাতার উপকারিতা

সজনে পাতা

সজনে গাছ আমাদের দেশে অনাদরে অবহেলায় শহর, পথে-প্রান্তরে, গ্রামাঞ্চলে, খালি জায়গায় বেড়ে উঠতে দেখা যায় । এই গাছ আমাদের দেশের অতিপরিচিত একটি নাম এবং অতিপরিচিত একটি গাছ ।

গ্রামের-অঞ্চলের প্রতিটি বাড়িতে এবং শহরের অনেক জায়গায় অনাদরে ও অবহেলায় বেড়ে ওঠে এই গাছ । কিন্তু অত্যান্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই গাছের উপকারিতা সম্পর্কে আমরা অনেকেই জ্ঞ্যাত নই ।

আজকের আলোচনায় সজনে গাছ, পাতা এবং এই গাছের গুনাগুন সম্পর্কে আপনাদের সাথে আলোচনা করবো । তাহলে চলুন শুরু করা যাক ------

বিশ্বে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কারণে, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বেশি হওয়ায়, বিশ্বব্যাপী বিশেষত অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোর একটি বিরাট অংশ বিশেষ করে শিশু ও মহিলারা অপুষ্টি, ভিটামিন স্বল্পতা, ক্যালসিয়াম স্বল্পতা ইমিউনিটি বা প্রতিরক্ষা জনিত রোগ, ক্যান্সার ইত্যাদিতে আক্রান্ত হচ্ছে ।

এই বিরাট জনগোষ্ঠীর জন্য একটি সুখবর হলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে আবিষ্কৃত হয়েছে যে, সজনে পাতা এসব রোগ প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে ।

সজনে গাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম

সজনে গাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম হচ্ছে Moringa oleifera/ মরিঙ্গা অলিফেরা, বাংলায় সজনে বা সজিনা গাছ ।

সজনে পাতার গুনাগুন

সজনে গাছ আমাদের দেশে অনাদরে অবহেলায় শহর, পথে-প্রান্তরে, গ্রামাঞ্চলে, খালি জায়গায় বেড়ে উঠতে দেখা যায় । অথচ এই সজনে গাছ আমরা ইচ্ছা করলেই ঘরের সামনে খালি জায়গায়, ছাদে টবের মধ্যে লাগাতে পারি এবং যা সহজেই যত্ন ছাড়া বেড়ে ওঠে ।

দি্র্যদিন ধরে সজনে গাছের পাতা ভাজি হিসাবে এবং সজনে ডাটা চচ্চড়ি, ডাল সহযোগে স্যুপ হিসাবে আমাদের দেশসহ বিভিন্ন দেশে ব্যাপক সুস্বাদু খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে ।

বিজ্ঞানীরা সজনে পাতার পুষ্টিগুণ বিচার করে এই পাতাকে “পুষ্টির ডিনামাইট” বলে উল্লেখ করেছে । বিজ্ঞানীরা মনে করেন সজনের পাতা পুষ্টিগুণের আঁধার । নিরামিষভোগীরা সজিনার পাতা থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হতে পারেন ।

সজনে পাতার পুষ্টিগুণ

পরিমাণের ভিত্তিতে তুলনা করলে একই ওজনের সজিনা পাতায় কমলা লেবুর থেকে ৭ গুণ ভিটামিন-সি, দুধের থেকে ৪ গুণ ক্যালসিয়াম এবং দুই গুণ আমিষ, গাজরের থেকে ৪ গুণ ভিটামিন-এ, কলার থেকে ৩ গুণ বেশি পটাশিয়াম বিদ্যমান ।

👉 বিজ্ঞানীরা আরও বলেন সজিনা পাতায় যে পুষ্টিগুণ রয়েছে তা হলো -----

  • আমিষ ৪২%,
  • ক্যালসিয়াম ১২৫%,
  • ম্যাগনোসিয়াম ৬১%,
  • পটাশিয়াম ৪১%,
  • লৌহ ৭১%,
  • ভিটামিন-এ ২৭২% এবং
  • ভিটামিন-সি ২২% বিদ্যমান আছে ।

এছাড়া দেহের আবশ্যকীয় বহু পুষ্টি উপাদান থাকে এ পাতায় ।

একটি উল্লেখযোগ্য কথা যে, আমরা বর্তমানে পুষ্টি এবং ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, এন্টি অক্সিডেন্ট এর জন্য এসব উপাদান আলাদাভাবে বিভিন্ন উৎস থেকে পেতাম যেমন- ভিটামিন সি এর জন্য আমলকি, কমলা, আমিষ বলতে মাছ, মাংস, এন্টি অক্সিডেন্ট এর উৎস বলতে টমেটো, হলুদ ফলমূল যেমন- গাজর, পেঁপে, ক্যালসিয়াম বলতে দুধ, হাড় হাড্ডি ইত্যাদি বুঝতাম । কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সুষম খাবারের প্রতিটি উপাদান অধিক পরিমাণে এই পাতার মধ্যে বিদ্যমান ।

গর্ভাবস্থায় সজনে পাতা

সজনে পাতা নিয়মিত খেলে গর্ভবতী মায়েদের দৈনিক আয়রন এবং ক্যালসিয়ামের চাহিদা খুব ভালো ভাবে পূরণ হয় । এছাড়া যেসব মা বুকের দুধ খাওয়ান তাদের বুকের দুধের পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পায় ।

এছাড়া যেসব রোগী হৃদরোগের ঝুঁকিতে আছেন তাদের শরীর থেকে খারাপ চর্বি LDL এর পরিমান কমিয়ে ভালো চর্বি HDL পরিমাণ বৃদ্ধি করে ।

এক টেবিল চামচ শুকনা সজিনা পাতার গুঁড়া থেকে গর্ভাবস্থায় অত্যবশ্যকীয় ১৪% আমিষ, ৪০% ক্যালসিয়াম ও ২৩% লৌহ ও ভিটামিন-এ সরবরাহ হয়ে থাকে । দৈনিক ৬ চামচ সজনে পাতার গুঁড়া একটি গর্ভবর্তী বা স্তন্যদাত্রী মায়ের চাহিদার সবটুকু ক্যালসিয়াম ও আয়রন সরবরাহ করতে সক্ষম ।

ডায়াবেটিস রোগীর কাঁচা সজনে পাতার উপকারিতা

যারা ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত তারা নিয়মিত কাঁচা সজনে পাতা রস করে খেতে পারেন যা অত্যান্ত উপকারি । সজনের পাতায় থাকা বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, খনিজদ্রব্য রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে থাকে ।

দেশে এবং দেশের বাইরে বেশ কয়েকটি গবেষনায় দেখা যায় যে, সজনে থাকা বিভিন্ন উপাদান রক্তে শর্করার মাত্রা কমিয়ে দেয়, ফলে এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বেশ উপকারি ।

প্রতিদিন সকালে কাঁচা সজনে পাতা রস করে খেলে পিত্ত এর কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা হ্রাস করে ।

সজনে পাতার ব্যবহার

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সজনে গাছের পাতা, ফুল এবং শজনে ডাঁটা বিভিন্ন ভেষজ ঔষধ হিসাবে ব্যবহৃত হয় । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সজনে পাতা থেকে তৈরি গ্রীন টি বা হারবাল টি, পেস্ট, ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল তৈরি হয় বিশ্ব ব্যাপি । সজনে ফুল থেকে তৈরি হয় খাবার তেল এবং সজনে ডাঁটা থেকে তৈরি হয় স্যুপ ।

সজনে পাতার উপকারিতা

এই সজনে পাতার অসংখ্য উপকারিতা রয়েছে । এর মধ্য থেকে উল্লেকযোগ্য ১০ টি উপকারিতার কথা জেনে নিই ---

১। মানবদেহের ২০ শতাংশ বিভিন্ন অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়ে গঠিত । সজনে পাতাতে দরকারি প্রত্যেকটি অ্যামাইনো এসিড পাওয়া যায় । সজনে পাতা আমিষের পরিবর্তে ব্যবহার করা একটি উৎকৃষ্ট খাবার হিসাবে বিবেচিত ।

২। বিভিন্ন ফলের তুলনায় সজনে পাতাতে ভিটামিন সি, বিটা ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম অত্যন্ত বেশি পরিমাণ আছে যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন ।

৩। সজনে পাতায় আছে প্রচুর পরিমাণ আয়রন এবং জিংক ফলে রক্তস্বল্পতার চিকিৎসায় এটি দারুন ভাবে কাজ করে ।

৪। এই গাছের পাতাতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম থাকার কারণে এটি হাড়ের ক্ষয় রোধ করে এবং দাঁতের গঠন ভালো রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে ।

৫। সজনে পাতা নিয়মিত খাবার ফলে মানবদেহের খারাপ কোলেস্টেরল এলইডি কমিয়ে এর পরিবর্তে এইচডিএল এর মাত্রা বাড়িয়ে দেয় ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে এটি অত্যন্ত সহায়ক ।

৬। এই পাতার রস নিয়মিত রস করে খেলে পেটের আলসার এবং হেপাটাইটিস রোগ নির্মূল করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে ।

৭। এই পাতাতে প্রচুর পরিমাণ এন্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় এটি নিয়মিত খেলে ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায় এবং ত্বকে সজনে পাতার রস নিয়মিত ব্যবহার করলে মুখের ব্রণ ও কালো দাগ দূর করতে সহায়তা করে ।

৮। এই পাতায় আছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন এ যা চোখের দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখতে সহায়তা করে । চোখের দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখার জন্য নিয়মিত সজনে পাতা নিয়মিত খেতে পারেন ।

৯। ক্ষতস্থান সারানোর জন্য এবং কোন পোকা মাকড়ের কামড়ালে এন্টিসেপটিক হিসেবে সজিনা পাতা বেটে পেস্ট করে লাগালে অতিদ্রুত ভালো ফলাফল পাওয়া যায় ।

১০। একজন গর্ভবতী মায়ের প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়াম ও আয়রন এর সবটুকু চাহিদা পূরণ করতে পারে সজনে পাতা । মায়ের বুকের দুধ বৃদ্ধিতেও অনেক সহযোগিতা সাহায্য করে থাকে ।

সজনে পাতার গুড়া করার নিয়ম

সজনে পাতার উপকারিতার ব্যাপারে গবেষনা করে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা একে “নিউট্রিশন্স সুপার ফুড” বা পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ খাবার” বলে উল্লেখ করেছেন । আবার অনেকে একে “মিরাকেল ট্রি” বা “অত্যাশ্চর্য্য গাছ” বলে থাকেন ।

এই পাতা গুড়া করা একেবারেই সহজ । প্রথমে এই পাতা ডাল থেকে ছাঁড়িয়ে হালকা ভাবে পানিতে ধুয়ে রোদ্রে দিতে হবে । তারপর মুচমুচে হয়ে গেলে হাত দিয়ে গুড়া করুন । এরপর ব্লেন্ডারে দিয়ে ভালো ভাবে ব্লেন্ড করে নিন । সজেন পাতা কাঁচা খাওয়া যেমন উপকারি তেমনি এর গুড়াও উপকারি ।

সজনে পাতার চা

সজিনা পাতার চা বা (Moringa Tea) অনেক অনেক উপকারী একটি পানীয় । এতে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন, আয়রন, ক্যালসিয়াম, বিটা-ক্যারোটিন যা দেহের বিভিন্ন উপকারের সাথে রয়েছে ওজন কমানোসহ রয়েছে নানা অসংখ্য উপকারিতা ।

নিম্নে সজনে পাতার চা-বানানোর প্রনালী বর্ননা করা হলো ।

প্রয়োজনীয় উপকরণঃ

১) সজিনা পাতা পাঁচ গ্রাম, ২) আদা, ৩) দারুচিনি, ৪) কাঁচা জিরা, ৫) মধু, ৬) ৪০০ এমএল বা দুই কাপ পানি ।

প্রথমে একটি পাত্রে পানি দিয়ে চুলায় দিন । তারপর এক এক করে আঁদা, দারুচিনি, কাঁচা জিরা, মধু দিন । এরপর শেষে শুকনা সজনে পাতা দিয়ে দিন । খুব ভালো ভাবে ফুটলে নামিয়ে পরিবেশন করুন এই চা ।

মরিংগা পাউডার খাওয়ার নিয়ম

সজনে ফুল বা ডাটার থেকে পাতা উপকারিতা এবং পুষ্টিগুন অনেক বেশি । এই পাতাকে বিশেষজ্ঞরা “পুষ্টির আধার” বলে অবিহিত করেন । দক্ষিন আফ্রিকাতে এই পাতাকে মায়েদের উপকারি বন্ধু হিসাবে জানা ও মানা হয়ে থাকে । এই পাতা আপনিও কাঁচা ও গুড়া দুই অবস্থায় খেতে পারেন ।

খাওয়ার নিয়ম হচ্ছে সকালে নাস্তার পরে এক বা আধা চা-চামচ পাউডার পানিতে মিশিয়ে খেতে পারেন । আবার রাতে উষ্ণ গরম পানিতে বা একগ্লাস দুধের সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন । এর সাথে মধুও মেশাতে পারেন ।


এই আর্টিকেল থেকে আপনারা যদি উপকৃত হয়ে থাকেন তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করবো । আপনাার যদি অন্য কোনো বিষয়ে আর্টিকেল পড়তে চান তাহলে “জিনিয়াস বাংলা ব্লগ” এর কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানিয়ে দিন ।


আরও পড়ুনঃ কফির উপকারিতা অপকারিতা

Previous Post Next Post