হযরত
উসমান রাঃ এর শাহাদাত | হযরত উসমান রাঃ - ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান ইবনে আফফান
রাঃ (عثمان بن عفان) ৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে
মক্কার ঐতিহ্যবাহী কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন ব্যক্তি
। হযরত উসমান রাঃ তখনকার সময়ে আরবের মুষ্টিমেয় শিক্ষিত লোকদের মধ্যে একজন এবং অন্যতম
ছিলেন ।
হযরত উসমান রাঃ ছিলেন কুরাইশ বংশের অন্যতম কুস্তি বিদ্যার বিশারদ । কুরাইশদের প্রাচীন ইতিহাস বিষয়েও তিনি ছিলেন গভীর জ্ঞানের অধিকারী । হযরত উসমান রাঃ বিপুল ধন ঐশ্বর্যের অধিকারী ছিলেন যার কারণে তিনি গনি উপাধি লাভ করেন ।
আরও পড়ুনঃ হযরত ওমর রাঃ এর শাহাদাত | হযরত ওমর রাঃ
আরও পড়ুনঃ হযরত হুসাইন রাঃ এর শাহাদাত
হযরত উসমান রাঃ প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম । হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাঃ- এর উৎসাহে তিনি দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করেন যৌবনে । তিনি নিজেই বলেছেন “আমি ইসলাম গ্রহণকারী চারজনের মধ্যে চতুর্থ” ।
হযরত আবু বকর রাঃ, হযরত আলী রাঃ, ও হযরত জায়েদ
বিন হারিস রাঃ এরপর হযরত উসমান রাঃ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন । কুরাইশ বংশের অত্যন্ত সম্মানিত
ও বিত্তবান ব্যক্তি হওয়া সত্বেও ইসলাম গ্রহণ করার কারণে তাকে কাফিরদের অমানুষিক নির্যাতনের
শিকার হতে হয়েছে । সীমাহীন নির্যাতনের পরও তার ঈমান একটুও টলেনি ।
হযরত ওমর রাঃ যখন ছুরিকাহত হয়ে মৃত্যুশয্যায়, তখন তার কাছে পরবর্তী খলিফা মনোনয়নের দাবি উত্থাপিত হলে তিনি বলেন, তোমাদের সামনে এমন একটি দল রয়েছে, যাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, তারা জান্নাতের অধিবাসী ।
তারা হলেন হযরত আলী রাঃ, হযরত উসমান রাঃ, হযরত
আব্দুর রহমান রাঃ, সাদ রাঃ, জুবায়ের রাঃ ও তালহা রাঃ । তাদের যেকোনো একজনকে খলিফা
নির্বাচিত করতে হবে । মানদণ্ডে উন্নীত রাসুল (সাঃ)-এর পবিত্র জবানের দ্বারা জান্নাতের
সংবাদপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই খিলাফতের যোগ্যতম উত্তরাধিকারী ।
হযরত ওমর রাঃ উল্লেখিত ৬ জনকে নিয়ে একটি বোর্ড গঠন করেন । পরে তিন দিনের সময় বেঁধে দিয়ে বলেন, আমার মৃত্যুর পর তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিজেদের যেকোনো একজনকে ঐক্যমতের ভিত্তিতে খলিফা মনোনীত করবেন । হযরত ওমর রাঃ-এর ইন্তেকাল হলো ।
বোর্ড সদস্যরা রুদ্ধদ্বার
বৈঠকে বসলেন, তুমুল তর্ক বিতর্ক, বাকবিতন্ডা চলল । সময় গড়িয়ে দুই দিন পেরিয়ে গেল
। মসজিদে নববী লোকে লোকারণ্য । শেষ দিন আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ বললেন, আমি আমার
খিলাফতের দাবি ত্যাগ করছি । এবার তোমরা তোমাদের মধ্যে যোগ্যতম ব্যক্তি নির্বাচনের দায়িত্ব
আমাকে অর্পণ করতে পারো ।
সবাই
খলিফা নির্বাচনের ক্ষমতা আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ-কে অর্পণ করলেন । অতঃপর হযরত ওমর
রাঃ কর্তৃক বেঁধে দেওয়া সময়ের শেষ দিনে ফজরের নামাজের পর মসজিদে নববীতে সমবেত মদিনাবাসীর
উদ্দেশ্যে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ এরপর তিনি খলিফা হিসাবে হযরত উসমান রাঃ-এর হাতে বাইয়াত
গ্রহণ করেন ।
এভাবেই
মানবতাবাদী, ক্ষুধা-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সদা তৎপর, বিনয় ও ভদ্রতার অনন্য উদাহরণ হযরত
উসমান রাঃ খিলাফতের দায়িত্ব লাভ করেন । খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর হযরত উসমান
রাঃ পুরো রাজ্যজুড়ে বেশ কয়েকজন নির্দেশকারী তথা দূত নিযুক্ত করেছিলেন । তাদের দায়িত্ব
ছিল হযরত ওমর রাঃ-এর প্রণীত আইন সমূহ প্রতিষ্ঠা করা । হযরত উসমান রাঃ-এর রাজ্য বিস্তৃত
করেছিলেন পশ্চিম থেকে পুরো মরক্কো পর্যন্ত ।
পূর্ব-দক্ষিণ-পূর্ব
তথা বর্তমান পাকিস্তান পর্যন্ত এবং উত্তর আমেরিকা থেকে আজারবাইজান পর্যন্ত হযরত
উসমান রাঃ-এর রাজত্বকালে তিনিই সর্বপ্রথম ইসলামিক নৌ বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন । হযরত
উসমান রাঃ অনেক বিশিষ্ট সাহাবাদের তার নিজস্ব প্রতিনিধি হিসাবে, রাজত্বের অবস্থা, জনগণের
সুযোগ সুবিধা, অসুবিধা, অবস্থা, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, তার বাস্তবায়ন খতিয়ে দেখার লক্ষ্যে
বিভিন্ন প্রদেশে পাঠাতেন । হযরত উসমান রাঃ ১২ বছর যাবত খলিফা হিসাবে রাজত্ব করেছিলেন
। এই রাজত্বকালের প্রথম ছয় বছর রাজ্যের শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যয় করেছিলেন ।
তিনি
খেলাফতে রাশেদীনদের মধ্যে অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন । বিপুল ধন-ঐশ্বর্য মালিক হযরত
উসমান রাঃ মুসলিম জাহানের খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পরও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন ।
হযরত হাসান রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-হযরত উসমান রাঃ মসজিদে নববীতে মাথার নিচে চাদর
দিয়ে শুয়ে থাকতেন । মানুষ তার পাশে এসে বসতো । তিনি তাদের সাথে কথা বলতেন । মনে হতো
তিনি তাদেরই একজন ।
জুবায়ের ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণনা করেন, হযরত উসমান রাঃ সারা বছর রোজা রাখতেন । সারারাত নামাজ পড়তেন । রাতের প্রথমার্ধে একটু ঘুমাতেন । হযরত উসমান রাঃ তার শাসনামলের প্রথমদিকে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেন । তার জনহিতকর কার্যাবলী তখনকার সমাজের চেহারা পরিবর্তন করে দিয়েছিল ।
খাল খনন করে কৃষিতে
উন্নতি সাধন করেন । পয়ঃপ্রণালী ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করে জনগণের অত্যান্ত প্রিয় খলিফায়
পরিণত হয়েছিলেন । মসজিদে নববীর আধুনিকায়ন করেন তিনি । তার অর্থনৈতিক সচ্ছলতা মদিনার
ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল ।
কোন আয়াত
বা সূরা নাযিল এরপর সাহাবাদের মুখস্ত করতে ও লিখে রাখতে নির্দেশ দেওয়া হতো । প্রকৃতপক্ষে
রাসুল (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় পবিত্র আল কোরআন সংকলন ও সংরক্ষিত হয়েছিল । যখন কোন আয়াত
রাসুল (সাঃ)-এর প্রতি নাযিল হতো, তিনি অনতিবিলম্বে তা মুখস্ত করে নিতেন । পরে সাহাবাদের
শোনাতেন এবং তাদের মুখস্ত করতে ও লিখে রাখতে বলতেন । তাছাড়া শুদ্ধতা যাচাই করতেন অর্থাৎ
সাহাবীদের স্মরণশক্তি পরীক্ষা করে দেখতেন ।
তিনি
সাহাবীদের সুরার ধারাবাহিকতা বলে রাখতেন । যেমন-প্রথমে যে সূরা নাযিল হয়েছে সূরা আলাক
পবিত্র আল-কুরআনে ৯৬ নং সূরা । যা তিনি জিব্রাইল (আঃ)-এর মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন ।
প্রতি রমজানে রাসূল (সাঃ) জিব্রাইল (আঃ)-দ্বারা পুনরাবৃত্তি করতেন । রাসুল (সাঃ)-এর
মৃত্যুকালীন বছরে রমজানের সময় তিনি দুই বার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন ।
পবিত্র আল-কোরআন সংরক্ষিত হয়েছিল বিভিন্ন আঙ্গিকে- গাছের বাকলে, চামড়ায়, উটের সেডলে, সমতল পাথরে, গাছের পাতায় । মুসলিম জাহানের প্রথম খলিফা আবু বক্কর রাঃ-এর খিলাফতকালে ইয়ামামার যুদ্ধে বহু কোরআনে হাফেজ শহীদ হন ।
হযরত আবু বক্কর রাঃ ও হযরত ওমর রাঃ সাহাবীগণের সঙ্গে
আলোচনা সাপেক্ষে যায়েদ বিন সাবিদ রাঃ-কে পবিত্র কোরআন সংকলনের জন্য দায়িত্ব প্রদান
করেন । সাহাবীদের একসঙ্গে করে যায়েদ বিন সাবিদ রাঃ সব কোরআনের আয়াতকে একসঙ্গে করেন
। এরপর তা দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর রাঃ- এর তত্ত্বাবধানে আসলে তার হাত থেকে হযরত হাফসা
রাঃ-এর নিকট পৌঁছায় ।
মহান
আল্লাহ এবং তার রাসুল (সাঃ)-এর সঙ্গে হযরত উসমান রাঃ এর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল
। মানবতার কল্যাণে জীবন ও সম্পদ উৎসর্গকারী সম্পর্কে রাসুলে খোদা (সাঃ) বলেছেন, “উসমান
হল তাদেরই একজন, যারা আল্লাহ ও রাসূলকে বন্ধু ভাবেন এবং আল্লাহ ও রাসুল তাদের বন্ধু
ভাবেন” । রাসুলুল্লাহ (সাঃ) প্রথম নিজের মেয়ে হযরত খাদিজা রাঃ-এর গর্ভের সন্তান রুকাইয়াকে
হযরত উসমান রাঃ- এর সঙ্গে বিবাহ দেন । হিজরী দ্বিতীয় সনে তাবুকের যুদ্ধের পর মদিনায়
রুকাইয়া রাঃ মারা যান ।
এরপর
রাসুল (সাঃ) তার দ্বিতীয় কন্যা উম্মে কুলসুমের সঙ্গে হযরত উসমান রাঃ- এর সঙ্গে বিবাহ
দেন । এ কারনে হযরত উসমান রাঃ যুন-নূরাইন বা দুই জ্যোতির অধিকারী হিসাবে খ্যাত । রাসুলুল্লাহ
(সাঃ) তাকে একাধিকবার জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন । রসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন, “প্রত্যেক
নবীরই বন্ধু থাকে । জান্নাতে আমার বন্ধু হবে উসমান” । হযরত উসমান রাঃ ছিলেন রাসুলুল্লাহ
(সাঃ) এর কাতিবে ওহী দলের অন্যতম ।
হযরত
উসমান রাঃ খিলাফতের মসনদে আসীন হয়েই বড় ধরনের এক সমস্যার সম্মুখীন হন । ওবায়দুল্লাহ
ইবনে উমার হযরত ফারুকে আযমের হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে কয়েকজন নাসারা ও মুনাফিক প্রকৃতির
মুসলমানকে হত্যা করেন । হযরত উসমান রাঃ নিজের সম্পদ থেকে নিহতদের ওয়ারিশদের রক্তপণ
দেওয়ার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করেন । ফলে মুসলমানদের ভেতরের সব বিভেদের অবসান হয়
।
হযরত উসমান রাঃ অত্যন্ত জনপ্রিয় খলিফা হিসাবে দায়িত্ব পালন করে যেতে লাগলেন । কিন্তু খলিফার সরলতা, সহিষ্ণুতা ও উদারতার সুযোগে স্বার্থন্বেষী হযরত উসমান রাঃ-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে ।
খিলাফতের অষ্টম বছরে হযরত উসমান রাঃ স্বজনপ্রীতি, কোরআন দগ্ধিকরণ, চারণভূমির
রক্ষণাবেক্ষণ, আবুজর গিফারী এর নির্বাসন, বায়তুল মালের অর্থ অপচয় ইত্যাদি অভিযোগে
অভিযুক্ত হয়ে বিরুদ্ধবাদীদের বিরোধিতা ও বিদ্রোহের সম্মুখীন হন । অথচ খলিফা হযরত
উসমান রাঃ- এর বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগই ছিল মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর ও অবাস্তব ।
হাম্মাদ ইবনে সালমা বর্ণনা করেন, হযরত উসমান রাঃ যে দিন খলিফা নির্বাচিত হন, সেদিন থেকে তিনি সর্বোত্তম ব্যক্তি ছিলেন । আর যখন তাকে লোকেরা হত্যা করল, তিনি সেদিন থেকেও উত্তম ছিলেন যেদিন তাকে খলিফা বানানো হয়েছিল ।
শেষ পর্যন্ত মিশর, বসরা ও কুফার বিদ্রোহী গোষ্ঠী
একাট্টা হয়ে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় সমবেত হয়ে খলিফার পদত্যাগ দাবি করেন । পবিত্র
হজ উপলক্ষে বেশিরভাগ মদিনাবাসী মক্কায় অবস্থান করায় তারা এ সময়কেই মোক্ষম সুযোগ
হিসেবে গ্রহণ করেন । হযরত উসমান রাঃ পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানালে তারা হত্যার হুমকি দিয়ে
তাকে অবরুদ্ধ করে রাখে ।
হযরত উসমান রাঃ রক্তপাতের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন । বিশাল মুসলিম জাহানের খলিফা হিসাবে মুষ্টিমেয় বিদ্রোহী কঠোর শাস্তি দানের পরিবর্তে তিনি তাদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে থাকলেন । হযরত আলী, তালহা ও জুবায়ের রাঃ-এর ছেলেদের দ্বারা গঠিত ১৮ নিরাপত্তারক্ষী বিপথগামী বিদ্রোহীদের মোকাবেলায় ব্যর্থ হন ।
অবশেষে তারা ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ই জুন আসরের নামাজের পর ৮২ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ খলিফাকে অত্যন্ত বর্বর ভাবে হত্যা করে । শহীদ হন মুসলিম জাহানের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান রাঃ ।
এই রকম আরো পোস্ট পেতে চাইলে “জিনিয়াস বাংলা ব্লগ” এর কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে আমাদের জানিয়ে দিন । আমরা আপনাদের চাহিদা অনুযায়ী লেখা পোস্ট করার চেষ্টা করবো ।
আরও পড়ুনঃ হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাঃ এর জীবনী | Biography of Hazrat Abu Bakr Siddique